ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক : দশ বছর আগে ও পরে
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক
০৪ জুন ২০১৫,বৃহস্পতিবার, ১৮:৪২
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক
বিগত সপ্তাহের বুধবার (২৭ মে ২০১৫) এই পত্রিকার ৬ নম্বর পৃষ্ঠায় আমার কলামের শিরোনাম ছিল- 'ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক : দশ বছর আগে ও পরে'। বস্তুত ভারত-বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এখন থেকে সাড়ে দশ বছর আগে ৬ জানুয়ারি ২০০৫ নয়া দিগন্ত পত্রিকায় আমার একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। আজ সাড়ে দশ বছর পর, এটা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক যে, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আমাদের অনুমান বা কল্পনা বা মূল্যায়ন মোতাবেক অগ্রসর হয়েছে নাকি অন্যভাবে অগ্রসর হয়েছে। ৬ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুই দিনের জন্য বাংলাদেশ সফরে আসছেন, সেহেতু ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক প্রসঙ্গে আলোচনা অত্যন্ত সময়োপযোগী। ২৭ মে তিনটি প্রশ্ন ও উত্তর উদ্ধৃত করেছিলাম এবং এ মুহূর্তের মন্তব্য লিখেছিলাম। আজকে আরো কয়েকটি প্রশ্ন ও উত্তর উদ্ধৃত করছি এবং মন্তব্য করছি।
৬ জানুয়ারি ২০০৫-এর চতুর্থ প্রশ্ন ও উত্তর
প্রশ্ন : ছিটমহল সমস্যা দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে দীর্ঘ দিন ধরে তিক্ত প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। আপনার দৃষ্টিতে, এ সমস্যার কি সমাধান করা যায়? ৬ জানুয়ারি ২০০৫-এর উত্তর : ছিটমহল সমস্যা আসলেই একটা বড় সমস্যা। এই সমস্যা বাংলাদেশের জনগণের দৃষ্টিতে প্রথম এসেছে চার বছর আগে যখন রৌমারিতে (মহিমাগঞ্জে) ভারতীয় বিএসএফ বাংলাদেশের ভেতরে আক্রমণ করতে গিয়েছিল এবং ওই প্রক্রিয়ায় তাদের ১৬ জন কিংবা ১২ জন লোক প্রাণ হারিয়েছিল। সে সময় 'সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড পিস স্টাডিজ'-এর নির্বাহী পরিচালক ছিলাম। আমরা তখন একটা আলোচনা সভার আয়োজন করি, ওখানকার লোকজনকে ডেকে নিয়ে আসি এবং ওই সময় বাংলাদেশের বিদগ্ধ ব্যক্তিগণ বা সাংবাদিকগণ বিভিন্ন মাধ্যমে এ বিষয়টি তুলে ধরেন। এই প্রথমবার কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ ছিটমহল সমস্যা নিয়ে অবহিত হলো। এটা কি বাংলাদেশের সুশীলসমাজ, সাংবাদিকসমাজ বা জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের ব্যর্থতা নয়? ২৯ বছর পর সংঘর্ষ হওয়ায় বাংলাদেশের জনগণ এ সম্পর্কে জানল। আমরা চাই না, আরেকটি সংঘর্ষ হোক। আমরা চাই ইতোমধ্যে যে সচেতনতা হয়েছে, সেই সচেতনতার কারণে এর যেন সমাধান হয়। এ জন্য ভারতের সাথে সমস্যার সমাধানে লেগে থাকতে হবে। কারণ, ভারত এ ব্যাপারে একটু ধীর প্রক্রিয়ায় যেতে চায়। এটা আসলেই একটা মানবিক সমস্যা, কূটনৈতিক সমস্যা, সীমান্ত সমস্যা, রাজনৈতিক সমস্যা। ব্যক্তিগতভাবে সেনাবাহিনীতে চাকরি করার সময় দায়িত্বের সুবাদে পুরো উত্তরবঙ্গে মাইলের পর মাইল হেঁটেছি এবং ছিটমহলে গিয়েছি। সেই ভ্রমণের মাধ্যমে জনগণের কষ্ট, দুঃখ-দুর্দশা যা দেখেছি তা অবর্ণনীয়। আজ ২০০৫ সালে পৃথিবীর কোনো জায়গা কি আছে যে জায়গার জনগণ জানে না যে, তারা কোন দেশের নাগরিক? ছিটমহলবাসী কোনো দেশেরই ভোটার নয়। তাদের কোনো দেশ রেশন দেয় না। তাদের দুর্যোগে কোনো দেশ খাদ্য সাহায্য দেয় না, চিকিৎসাসেবা দেয় না। এক কথায়, তারা বন্দী। এটা পৃথিবীর জনগণের সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন বলে। ১৯৪৭ সাল থেকে সৃষ্ট এই সমস্যার সমাধানে পাকিস্তান কিংবা ভারত বা বাংলাদেশ বিভিন্ন অজুহাতে সমাধানে কার্যকরভাবে অগ্রসর হচ্ছে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, কিছু দরকার হলে তাদেরকে দিয়ে দাও, তাদের থেকেও কিছুটা নিয়ে নাও। দেয়া-নেয়া করে সীমান্তকে সোজা করে ফেলো। যারা ভূগোল নিয়ে লেখাপড়া করেন এবং পরীক্ষার সময় বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকতে হয়, তাদের কষ্টের কথা বিবেচনা করলে বোঝা যায়, খুব কঠিন করে ফেলেছি আমাদের মানচিত্রকে। কেমন যেন আঁকাবাঁকা।
জানুয়ারি ২০০৫-এর চতুর্থ প্রশ্ন ও জুন ২০১৫-এর মন্তব্য
৪১ বছর পর হলেও ভারতীয় পার্লামেন্ট তাদের সংবিধান সংশোধন করে এই ছিটমহল সমস্যার সমাধান করছে। ইংরেজিতে প্রবাদবাক্য আছে, বেটার লেইট দ্যান নেভার। অর্থাৎ একদম না করার চেয়ে বিলম্বে করাও ভালো। বর্তমান ভারত সরকারকে আমার পক্ষ থেকে এবং বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির পক্ষ থেকে অভিনন্দন। বাংলাদেশে যেসব সরকার এ পর্যন্ত যতটুকুই পরিশ্রম করে থাকুক না কেন, ওই পরিশ্রমটুকুর জন্য সবাইকে অভিনন্দন।
জানুয়ারি ২০০৫-এর পঞ্চম প্রশ্ন ও উত্তর
প্রশ্ন : অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন সমস্যা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে কাজ করছে। এ ব্যাপারে দুই দেশের করণীয় কী? এ ক্ষেত্রে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? জানুয়ারি ২০০৫-এর উত্তর : এটাকে মূল্যায়ন করি বাংলাদেশের জন্য জীবন-মরণ সমস্যা হিসেবে। ফারাক্কা যখন তৈরি হয়েছে অর্থাৎ পাকিস্তান আমলে, তখন তারা পাকিস্তানকে জানায়নি বা পাকিস্তান সরকার জানতে পারেনি। বর্তমান সিলেটের বিপরীত দিকে, টিপাইমুখ প্রকল্পের ক্ষেত্রে ঠিকই দ্বিতীয়বার আমরা এ ধরনের ঘটনা দেখতে পেলাম। এখন আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পও এভাবেই তারা করে ফেলবে এবং এক সময় দেখা যাবে, সব কিছু করা হয়ে গেছে। তারা একটা ধোঁয়াটে অবস্থা সৃষ্টি করে রাখবে, যাতে জানতে পারা যাবে না যে, কী হচ্ছে। আমি বলতে চাই, ওটা বাংলাদেশকে মরুভূমি বানানোর জন্য চূড়ান্ত পদক্ষেপ। ফারাক্কার প্রভাবে উত্তর-পশ্চিম বাংলাদেশে কী হয়েছে, সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এর ওপর যখন আন্তঃনদী প্রকল্প হবে, তখন বাংলাদেশ আর পানি পাবে না। এটা হলো আমার ভয়। ভারতকে জোরালোভাবে সব মাধ্যমে বোঝাতে হবে যে, আপনাদের দেশের জনগণ যেমন মানুষ, আমাদের দেশের জনগণও মানুষ। আপনারা যেমন ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচন করেন, আমরাও করি। আপনাদের যেমন বেঁচে থাকার অধিকার আছে, আমাদেরও আছে। যে সৃষ্টিকর্তা আপনাদের রক্ষণাবেক্ষণ করছেন, তিনিই আমাদেরও করছেন। ওই সৃষ্টিকর্তার দেয়া বৃষ্টির পানি ও নদীগুলোকে আপনারা যদি এককভাবে কুক্ষিগত করেন, তাহলে আমাদের কী হবে? এটা কিন্তু একটা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। এ দায়িত্ব মিডিয়া ও সুশীলসমাজকে নিতে হবে। এ জিনিসগুলো কিন্তু কূটনৈতিক বইয়ের মধ্যে লেখা নেই কিংবা ফরেন পলিসির ট্রেনিং স্কুলগুলোতে তা পড়ানো হয় না। এটার জন্য দরকার উদ্ভাবনী শক্তির মাধ্যমে নতুন নতুন পন্থা উদ্ভাবন করা যে, কিভাবে আমরা সমস্যার সমাধান করতে পারি। এ জন্য, আমাদের মধ্যে যে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে তা আরো জোরদার করতে হবে। ভারতকে বোঝাতে হবেÑ নদী এবং নদীর পানি সৃষ্টিকর্তার দেয়া এবং সব মানুষের জন্য।
জানুয়ারি ২০০৫-এর পঞ্চম প্রশ্ন ও জুন ২০১৫-এর মন্তব্য
অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টন সমস্যার সমাধানে বিশেষ অগ্রগতি সাধিত হয়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফর করতে আসছেন। অনেক দিনের কাক্সিক্ষত, তিস্তা নদীর পানিসংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হচ্ছে না। ৫৪টি অভিন্ন নদী আছে, যেগুলো ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। এর মধ্যে কিছু নদী বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কিছু নদী কম গুরুত্বপূর্ণ। বড় বড় অভিন্ন নদীর মাধ্যমে ভারত পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অংশ, মধ্য-পশ্চিম অংশ এবং দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে অনেক ছোট ছোট নদী ও সংযোগ খাল শুকিয়ে গেছে। পদ্মা নদী সবচেয়ে বড় নদী। এ মুহূর্তে পরীক্ষা বা সার্ভে করলে দেখা যাবে, পদ্মার চার ভাগের তিন ভাগই চর এবং পানিশূন্য। অতএব, এ সমস্যা সমাধান করার জন্য ভারতের ওপর নৈতিক, মানবিক ও কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে। এ জন্য সুশীলসমাজ ও মিডিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকারপন্থী মিডিয়াকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
জানুয়ারি ২০০৫-এর পঞ্চম প্রশ্নর সম্পূরক প্রশ্ন ও সম্পূরক উত্তর
প্রশ্ন : বিষয়টি নিয়ে কিন্তু ভারতেও সমালোচনা হচ্ছে। আপনি কী বলেন? জানুয়ারি ২০০৫-এর উত্তর : সকল ভারতীয় কিন্তু বাংলাদেশবিদ্বেষী নন কিংবা সকল ভারতীয় অবিবেচক নন। বেশির ভাগ মানুষ বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং তারা বাংলাদেশের দুঃখ-দুর্দশা বোঝেন। কিন্তু তারা গরিষ্ঠ হচ্ছেন সংখ্যায়, তবে কণ্ঠস্বর ক্ষীণ। তাদের সেই কণ্ঠস্বরকে জোরালো করার দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে। যেমন, এক বছর আগে জানতে পেরেছি আমাদের পত্রিকার মাধ্যমে, বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলগুলো ইন্ডিয়ায় দেখা যায় না। আজ পর্যন্ত আমরা এর কোনো সমাধান করতে পারলাম না। 'আমারটা তুমি দেখতে দেবে না, তোমারটা আমি কোন দুঃখে দেখব- এ সিদ্ধান্ত আমরা নিতে পারতাম। এটাই ডা: মাহাথিরের কথা। সিদ্ধান্ত সব সময় জনপ্রিয় হয় না। বাংলাদেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধ করেছে সত্য কথা, কিন্তু দেশপ্রেমের মধ্যে ধার নেই। ধার থাকলে সবাই সীমান্ত এলাকার লোকজনকে বলতে পারত, আমরা চোরাচালান করব না। যা আছে তাই খাবো। ঢাকার লোকজন দান করত, ঢাকার লোকজন উপজেলায় মাল পাঠাতে বাধ্য হতো। আমাদের দেশের মাল নিয়ে সীমান্তের উপজেলার লোকজনকে বাঁচিয়ে রাখব। আমরা কেন চোরাচালান করতে যাবো। এখন প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, ইন্ডিয়ান চ্যানেলগুলো বন্ধ করলে বাংলাদেশ কি টিকতে পারবে? মিয়ানমার কি টিকছে না? আফগানিস্তান কি টেকেনি? মিয়ানমারের তো বক্তব্য একটাই, আমি উপযুক্তভাবে নিজেকে রক্ষা করার আগেই যদি খুলে দিই, তাহলে আমি কিন্তু ভেসে যাবো।' আপনি ইতোমধ্যে ভেসে গেছেন, কিন্তু আপনি নিজেকে যত বড় বাহাদুর ভাবেন না কেন, আপনার যে নিজের কোনো দাম নেই, সেটা আপনি নিজেই বুঝছেন যে, আপনার চ্যানেল দেখবে না। আর আপনারাও তাদের চ্যানেল হাতজোড় করে দেখতে চাইবেন। আরো বলতে চাই, বিভিন্ন ইস্যুতে আন্তর্জাতিকভাবে ফারাক্কার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে, তা পর্যাপ্ত নয় এবং এটা যথেষ্ট আন্তরিকতার সাথে বাংলাদেশীরা করেনি। মওলানা ভাসানী মারা গেছেন, ফারাক্কা ইস্যু বাংলাদেশে যেন মরে গেছে। হয়তো মওলানা ভাসানী যদি থাকতেন, ফারাক্কা ইস্যু থাকত। এখন একজন রাজনৈতিক নেতা নেই যিনি বলবেন, আমাদেরকে তোমরা মেরে ফেলছো, তোমাদের সাথে আমাদের কিসের বন্ধুত্ব? মরতে যদি হয় তাহলে যুদ্ধ করে মরব। যুদ্ধ মানে গোলাগুলি নয়, সংগ্রাম। এ বিষয়টি কোনো রাজনৈতিক নেতার মধ্যে নেই, সবার মধ্যে হাতজোড় করে বাঁচার ধান্ধা।
জানুয়ারি ২০০৫-এর ষষ্ঠ প্রশ্ন ও উত্তর
প্রশ্ন: ভারতের সাত রাজ্যের বিদ্রোহীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দানের বিষয়ে নয়াদিল্লি নিয়মিত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছে। একইভাবে 'স্বাধীন বঙ্গভূমি' নামে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের প্রশ্রয় দিচ্ছে ভারতÑ এ অভিযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। এ বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখছেন? ৬ জানুয়ারি ২০০৫-এর উত্তর : শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশও ভারতের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ দিচ্ছে। আর এটা খুবই স্বাভাবিক যে, একটি দেশের আরেকটি প্রতিবেশী দেশের ওপর এ ধরনের অভিযোগ দেয়া। প্রতিবেশী দেশের মধ্যে যদি উপযুক্ত জঙ্গল থাকে, লুকিয়ে থাকার মতো সুযোগ থাকে, তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই পারে। তার মানে এখানে বাংলাদেশ সরকার বারবার বলছে যে, আমরা প্রশ্রয় দিচ্ছি না। বাংলাদেশ বলছে, ঠিক আছে আপনারা আসেন এবং খুঁজে দেখেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বীণা সিক্রির উপস্থিতিতেই এগুলো বলে ফেলেছেন। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যখন বলছে, কলকাতায় এগুলো হচ্ছে, সেগুলো তো মিডিয়া থেকে বেরোচ্ছে। আমি মনে করি, উভয় দেশ যদি আরো স্বচ্ছ হয় তাহলে সমাধানের পথে এগিয়ে যাবে। আমাদের দেশের লোকজনকে ওরা অ্যালাও করুক, আমরা ওখানে যাই, ওদেরকে দেখি, ওদের সাথে কথা বলি এবং ওরাও আমাদের এখানে আসুক। এখন উভয় দেশ যদি চাই যে, আমরা কেউ কারো বিরুদ্ধে সাহায্য করব না, তাহলে স্বচ্ছতা আসা সম্ভব। আমি আপনাকে সাহায্য করব এবং আপনি আমাকে সাহায্য করবেন। আমার জানামতে, বাংলাদেশ এ ধরনের কাজগুলোর সাথে জড়িত নয়। আমার অবসরের পর আট বছর হয়ে গেছে; কিন্তু যত দূর জানি যে, বাংলাদেশ এ ধরনের কাজে সাথে জড়িত নয়। আমার চাক্ষুষ প্রমাণ যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িরা অবশ্যই ত্রিপুরায় আশ্রয় নিয়ে ওখান থেকেই প্রশিক্ষণ নিত এবং আমার সাথে শান্তিপূর্ণ আলোচনায় বসত। আমিই তাদের বর্ডার পার করে ওই পারে পৌঁছে দিতাম। এগুলো ওরা কখনো এড়িয়ে যায়নি। ওরা যদিও বলত, আমরা বিদ্রোহীদের আশ্রয় দিইনি, আমরা নিরীহ লোকজনকে আশ্রয় দিয়েছি, কিন্তু ওই লোকজনের মধ্যেই বিদ্রোহী বা গেরিলা মিশে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি নিজেও ভারতে আশ্রয় নিয়েছি।
জানুয়ারি ২০০৫-এর ষষ্ঠ প্রশ্ন ও জুন ২০১৫-এর মন্তব্য
পত্রপত্রিকার রিপোর্ট মোতাবেক, কূটনৈতিক ব্যক্তিবর্গের কথাবার্তা মোতাবেক, একটি কথা সর্বজন বিদিত যে, আওয়ামী লীগদলীয় বাংলাদেশ সরকার বিগত ছয় বছরে ভারতের একটি বড় উপকার করেছে। উপকারটি হলো, উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন উপদ্রুত রাজ্য যথা আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ইত্যাদির বিচ্ছিন্নতাবাদী বা গেরিলা বা চরমপন্থী সংগঠনগুলো বাংলাদেশের ভৌগোলিক এলাকা যেন ব্যবহার করতে না পারে। গত সাড়ে ছয় বছর ধরেই ভারত সরকার বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকারের প্রতি এ প্রসঙ্গে মহাসন্তুষ্ট। আমি শুধু নিশ্চিত হতে চাই যে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রামেও বিচ্ছিন্নতাবাদী বা গেরিলা বা চরমপন্থী সংগঠনগুলো যেন প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে কোনো প্রকার সাহায্য না পায়।
জানুয়ারি ২০০৫-এর সপ্তম প্রশ্ন ও উত্তর
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পুশইন সমস্যা অনেক সময় সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিক্ততা সৃষ্টি করে। এর সমাধানের উপায় কী? ৬ জানুয়ারি ২০০৫-এর উত্তর : এটা একটা বানানো সমস্যা। বাংলাদেশে যেমন দরিদ্র জনগোষ্ঠী আছে, তেমনি ভারতেও আছে। ভারত থেকে যত রকম লোক বাংলাদেশে আসে, তার কোনো নির্দিষ্ট হিসাব আমাদের কাছে নেই। আর আমাদের দেশ থেকেও সে দেশে কত ধরনের লোক গেছে, তারও হয়তো ভারতের কাছে কোনো হিসাব নেই। কিন্তু যারা ৩০ বছর ধরে ওখানে আছে তাদের জোর করে পাঠিয়ে দেবেন, এটা তো হিসাবে মিলছে না। সুতরাং 'পুশইন' দিয়ে কোনো দিনই সমস্যার সমাধান করতে পারবেন না এবং এটা আইনত গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় লোকজন যদি সজাগ থাকে, তাহলে এটা প্রতিহত করা সম্ভব বলে মনে করি। ভারতের কাছেও আবেদন করবÑ ওই নিয়মেই আপনার সমস্যার সমাধান না করে অফিসিয়াল সিস্টেমে আসেন। বাংলাদেশের লোকজন নিয়ে তাদের সামনে হাজির করান। বলুন, কারা কারা কোথা থেকে এসেছে। তারপর যদি বাংলাদেশকে রাজি করতে পারেন, বাংলাদেশকে বলবেন ফেরত নাও। বাংলাদেশের অবৈধ শ্রমিক কি মালয়েশিয়া থেকে ফেরত আসছে না, সৌদি আরব থেকে ফেরত আসছে না? এ ধরনের অবৈধ শ্রমিক যদি ভারতে থাকে, তবে ফেরত আসবে। কিন্তু পুশইন করা ঠিক নয়। এটা অমানবিক। রাতেরবেলায় বিলের মাঝখানে শীতকালে একজনকে ফেলে চলে গেলেন, তা কেমন করে হবে। আমার ব্যক্তিগত মতে, ভারতীয় লোক বাংলাদেশে অবশ্যই আছে, যারা সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে থাকে। স্থায়ীভাবে বাড়িঘর করে না। থাকলেও আসা-যাওয়ার মধ্যে আছে। ১৯৪৭ সালের পর যারা এ দেশে চলে এসেছে, তাদেরকে আমরা ভারতীয় কেন বলব? তেমনিভাবে যারা ভারত চলে গেছে, তাদেরকেও বাংলাদেশী বলা ঠিক হবে না। যারা চাকরি করছেন, বাপ-দাদার সম্পত্তি আছে, তাদেরকে কেন আমরা ভিন দেশের নাগরিক বলব?
জানুয়ারি ২০০৫-এর সপ্তম প্রশ্ন ও জুন ২০১৫-এর মন্তব্য
পুুশইন সমস্যা একটি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। মোদি সরকার দিল্লিতে ক্ষমতায় আছে বারো মাস ধরে। ক্ষমতায় আসার আগে নির্বাচনী প্রচারণার সময় বিজেপি একাধিকবার প্রচার করেছে, যারা ১৯৪৭-এর পরে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতীয় প্রদেশগুলোতে গেছে, তাদেরকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাব। ১৯৪৭ না হলেও বা না পারলেও ১৯৭১ তো বটেই। এখনো সেই ওয়াদাগুলো বাস্তবায়ন করা শুরু হয়নি। তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
জানুয়ারি ২০০৫-এর অষ্টম প্রশ্ন ও উত্তর
অনেকেই বলে থাকেন, বাংলাদেশের প্রতিকূলে বিপুল বাণিজ্য ঘাটতির জন্য নয়া দিল্লির রক্ষণশীল মনোভাব দায়ী। এ ব্যাপারে আপনার কী মত? ৬ জানুয়ারি ২০০৫-এর উত্তর : এ ব্যাপারে আমি আংশিকভাবে একমত। এর কারণ দিল্লি আমাদের দেশ থেকে অনেকটা রক্ষণশীল। দিল্লির ওপর দোষ না দিয়ে সময়ের পূর্বেই উদার হয়ে গেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দিল্লি তার রক্ষণশীলতাকে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে কমাচ্ছে। অপরপক্ষে বাংলাদেশ সময়ের সাথে তাল না মিলিয়ে বিদেশী লোকের প্রভাবে হোক অথবা নিজেদের অদূরদর্শিতাপূর্ণ সিদ্ধান্তের কারণে হোক, রক্ষণশীলতা হঠাৎ করে কমিয়ে দিয়ে বেশি উদার হয়ে গেছে। আর এই কারণে উভয় দেশের পলিসির মধ্যে তারতম্য দেখা যাচ্ছে। যা-ই হোক, শুধু এটা বললে একান্তই ভুল হবে। আপনাকে এটা মানতেই হবে যে, ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি আমাদের ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রির তুলনায় অনেক বেশি ইকোনমিক্যালও কমপিটিটিভ। ফলে এ ক্ষেত্রে মার খেতেই হবে। এ কারণে আমি শুধু ইন্ডিয়ান রক্ষণশীলতাকে দায়ী করব, এটা হয় না; দু-একটা আইটেম নিয়ে হয়েছে, ব্যাটারি বা এটা-ওটা। এটাকে ওভারকাম করা যায়, কিন্তু মূলত, যে কাউকে কমপিটিটিভ হয়ে আসতে হবে কোয়ালিটিতে এবং কস্টে।
জানুয়ারি ২০০৫-এর অষ্টম প্রশ্ন ও জুন ২০১৫-এর মন্তব্য
অগ্রগতি কিছু কিছু হয়েছে। গত পাঁচ-সাত দিনের পত্রপত্রিকায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে অনেক লেখালেখি ও সংবাদ হচ্ছে। তার মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতিও একটি বিরাট ইস্যু। অতি সাম্প্রতিক তথ্য মোতাবেক ভারত যদি আমাদের দেশ থেকে এক টাকা আমদানি করে তাহলে আমরা ভারত থেকে প্রায় পঁচাত্তর টাকা আমদানি করি। এত বড় তারতম্য বিপজ্জনক। মিষ্টি মিষ্টি কথায় এবং রাজনৈতিক ডামাডোলে আমরা এই কথাগুলো ভুলে যেতে চাই না। আমাদের ব্যবসায়ী সমাজ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ- সবাইকেই এই প্রসঙ্গে সোচ্চার হতে হবে বলে আমি মনে করি।
উপসংহার
৬ জানুয়ারি ২০০৫ থেকে ৩ জুন ২০১৫, সময়ের মেয়াদ হচ্ছে ১০ বছর পাঁচ মাস। এ সময়কালে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অবনতি কম হয়েছে; ক্রমান্বয়ে উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতিবিষয়ক ভাষ্যকার ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের একটি কথা উল্লেখ করতে চাই। প্রতিদিন মধ্যরাত ১২টা থেকে ১২:১৫ বা ১২:২০ মিনিট পর্যন্ত চ্যানেল আইতে সংবাদপত্র পর্যালোচনার যে নিয়মিত অনুুষ্ঠান হয়, সেখানে ৩১ মে ২০১৫ দিনের শেষে, অর্থাৎ পয়লা জুন তারিখের প্রথম প্রহরে, তিনি উপস্থিত ছিলেন। সেখানে তিনি বলেন অনেকটা এ রকম- 'ট্রানজিট শব্দটা কঠিন বা কঠোর। মানুষের মনকে শান্ত রাখার জন্য এই শব্দটা ব্যবহার না করে, কানেকটিভিটি নামক শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে। কানেকটিভিটি মানে, যোগাযোগ। বাস্তবে বাংলাদেশের মাটি ও পানি ব্যবহার করে ভারতীয় যানবাহনগুলো এপাশ-ওপাশ করছে কোনো বিঘœ ছাড়া। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বা কৌশলগত প্রাপ্য পাওয়ার জন্য যথেষ্ট উদ্যোগ আমি লক্ষ্য করছি না। এটা বাংলাদেশের জন্য দুঃখজনক।' পাঠক, নিজেরাই বিবেচনা করুন।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com
- See more at: http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/27777#sthash.xqq4ElYS.dpuf
No comments:
Post a Comment