Sunday, May 24, 2015

ইহুদি সম্প্রদায় : অত্যাচারিত থেকে অত্যাচারী

ইহুদি সম্প্রদায় : অত্যাচারিত থেকে অত্যাচারী

ইহুদি সম্প্রদায় : অত্যাচারিত থেকে অত্যাচারী : বর্তমান পৃথিবীর শাসক ও সুপারপাওয়ার : (১ম পর্ব)

আশরাফ মাহমুদ মুন্না 

ইহুদি সম্প্রদায় বা জুইশ কমিউনিটির ইতিহাস প্রায় ৩০০০ হাজার বছরের পুরনো। পৃথিবীর ইতিহাস টেনে আনলে দেখা যায়, ইহুদিরা হলো সবচেয়ে অত্যাচারিত সম্প্রদায়, যাদের উপর শুধু বছরের পর বছর, শতশত বছর ধরে অত্যাচার করা হয়েছে। একটি নির্যাতিত ও অত্যাচারিত সম্প্রদায় কিভাবে নিজেরাই অত্যাচারী হয়ে উঠল সে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

তিন হাজার বছর আগে ইহুদি সম্প্রদায়ের যাত্রা শুরু হয়। ইহুদীধর্ম পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীনতম ধর্ম যা এখনো অনেক মানুষ পালন করছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরেলিদের আদি নিবাস ছিল। তবে তারা এখন যে জায়গা চিহ্নিত করছে তা নিয়ে বিতর্ক আছে। আল্লার নবী মুসা (আঃ) বা মোজেস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই সম্প্রদায়ের সবচেয়ে সুন্দর সময় গিয়েছে খৃষ্টপূর্ব এক হাজার বছর আগে (হজরত) সম্রাট দাওদ (আঃ) বা ডেভিডের সময়। দাবি করা হয় বর্তমান সময়ের লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান ও মিশরের বড় অংশই ছিল তখনকার কিংডম অব ইসরেলের অংশ। ডেভিডের ছেলে (হজরত) সলোমন বা সোলাইমান (আঃ) এর সময়ও তাদের অবস্থা ভালো ছিল। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর এ-জাতি দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এ-সময় আসিরিয়ানরা ধীরে ধীরে এই অঞ্চলে ঢুকে পড়ে ও দখল করে নেয়। এরপর বিভিন্ন সময় ব্যাবিলনিয়ান, পার্সিয়ান, হেলেনেষ্টিক, রোমান, বাইজেনটাইন, অটোম্যান, বৃটিশ শাসনসহ বিভিন্ন পর্যায় পাড়ি দেয় এই অঞ্চল। আর এর প্রায় অনেকটা সময় জুড়েই ইহুদিদের তাড়া থেতে হয়। 

 
ধর্মীয় প্রতীক ৩ 

ঈজিপশিয়ান ফারাওদের (কোরানে, ফেরাউন-মুসা আঃ এর ঘটনা) সময় থেকে শুরু করে জার্মানির হিটলারের সময় পর্যন্ত তাদের বিতাড়িত হতে হয়েছে বিভিন্ন দেশ থেকে। তবে এখন যেমন ইহুদিদের সাথে মুসলমানদের সংঘাত চলছে এক সময় তা ছিল কৃশ্চিয়ান ও ইহুদি সংঘাত। স্পেনে মুসলমানদের রাজত্বে ইহুদিরা খুবই ভালো ছিল। তারা এ-সময় তাদের বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করার ব্যাপক সুযোগ পায়। মুসলমানদের এই উদারতার কথা ফুটে উঠেছে ইহুদিদের লেখা ইতিহাস বইয়ের পাতায়। 

শুরু থেকেই বিভিন্ন সমাজে ইহুদিদের ঘৃণিত, অবহেলিত ও খারাপভাবে দেখা হতো। প্রায় প্রতিটি জায়গায় তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকতো। উগ্র কৃশ্চিয়ানরা তাদের কখনোই সহ্য করতে পারেনি। এদের অনেকেই যিশুর হত্যাকারী হিসেবে ইহুদিদের চিত্রিত করেছে। অনেকেই তাদের অভিশপ্ত জাতি মনে করে। 

ইহুদিরা যেহেতু তাড়া খেত বেশী সেহেতু তারা যাযাবর জীবনে স্থায়ী কাজের চেয়ে বুদ্ধিনির্ভর ও কম শারীরিক পরিশ্রমের কাজ বেছে নেয়। ব্যবসার প্রতি কৃশ্চিয়ানদের অনিহা তাদের সামনে বড় সুযোগ এনে দেয়। তাদের বসবাসের পরিবেশ ছিল খুব খারাপ। ভালো খাবার দাবারও ছিল না। ফলে তারা এমন কাজে আত্মনিয়োগ করে যেখানে বুদ্ধির চর্চা বেশী। ব্যবসা, টাকাপয়সা, লেনদেন, দালালি - এসব কাজে তারা এগিয়ে যায় বেচে থাকার সহজাত প্রবৃত্তির জন্য। 

ইহুদি সম্প্রদায়কে ইউরোপে কিভাবে দেখা হতো তার বড় উদাহরণ হতে পারে উইলিয়াম শেকসপিয়ারের " মার্চেন্ট অব ভেনিস " নাটকের শাইলক চরিত্রটি। যে শরীরের মাংশ কেটে তার পাওনা আদায়ের দাবী জানায়। সম্পূর্ণ ভিন্ন সমাজের প্রেক্ষাপটে নিয়ে লেখা রাশিয়ান লেখক নিকোলাই গোগল তার তারাস বুলবা উপন্যাসে আরেক ইহুদি সুযোগ সন্ধানী চরিত্র ইয়ানকেল-কে সৃষ্টি করে দেখিয়েছেন তাদের সম্পর্কে তখনকার শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবিদের মনোভাব। 

ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশ থেকে নিয়মিত তাড়া খেয়ে তাড়া মিডল ইস্টে ঢুকতে থাকে। এর মধ্যে ইউরোপিয়ান একটি চালও ছিলো। কৃশ্চিয়ানরা যেহেতু ইহুদিদের পছন্দ করতো না তাই তারাও চাচ্ছিল মুসলমানদের এলাকায় তাদের ঢুকিয়ে দিতে। আর প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে যাযাবর জীবনের অবসানও চাচ্ছিলো ইহুদিরা। 

এতোগুলো বছর তাদের ঐক্য ধরে রাখার বড়া শক্তি ছিল ধর্ম। বিশ্বের বহু দেশে ছড়িয়ে পড়লেও ইহুদি সম্প্রদায়ের সব সময় স্বপ্ন ছিল তারা তাদের নিজ দেশ ইসরেলে ফিরে যাবে যদিও তখনো এর কোনো ভৌগলিক অস্তিত্ব ছিল না। ইসরেল তাদের মাতৃভূমি ও ধর্মভূমিই শুধু নয়, তাদের স্বপ্ন ভূমিও বটে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম স্বপ্ন দেখেছে ইসরেল নামের দেশের। নেক্সট ইয়ার ইন জেরুজালেম - এই শ্লোগান মাথায় রেখে বহু ইহুদি মারা গিয়েছে। ইসরেলের জন্য তারা সাধ্যমতো দান করেছে, ধর্ম ও বিশ্বাস দিয়ে নিজেদের এক করে রেখেছে। সংখ্যায় অত্যন্ত কম হওয়ার পরও ক্ষুরধার বুদ্ধি, কৌশল ও মেধার বিকাশ ঘটিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে নিজেদের বসিয়েছে। 

কোনো মেধাবী ইহুদী ছাত্র বা ছাত্রীর পড়াশুনার জন্য চিন্তা করতে হয় না। এখনো বহু ওয়েব সাইটে এদের জন্য দান গ্রহণ করা হয়। তারা প্রধানতঃ মাতৃতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখে। কমিউনিটির কেউ বিপদে পড়লে তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। এমন অনেক ওয়েব সাইট আছে যেখানে ইহুদি পরিবারগুলোর বংশলতিকা বা ফ্যামিলি ট্রি তৈরি করতে সাহায্য করে। 

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ধাওয়া খেয়ে ইহুদিরা বহু দেশে ছড়িয়ে পড়লেও তাদের স্বপ্নভূমির কথা কখনো ভোলোনি। এক্ষেত্রে তারা কট্টর ও চরমপন্থি। কারণ মিডল ইস্টের কোনো এক জায়গায় তাদের জন্মভূমি ছিলো তিন হাজার বছর আগে সেই যুক্তিতে একটি জায়গার দখল নেয়া একটি অবাস্তব বিষয়। কেননা এর কোনো সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। কিন্তু ইহুদিরা তা তৈরি করে নিয়েছে। তারা বিশ্ব শক্তিকে তাদের পক্ষে কাজে লাগিয়েছে। 

ইরাক যখন কুয়েত দখল করে নেয় তখন সাদ্দাম হোসেন বলেছিলেন, কুয়েত ঐতিহাসিকভাবে ইরাকের অংশ। কিন্তু সে যুক্তি বাতিল হলেও ইহুদিদের যুক্তি বাতিল হয়নি। এ-কারণে ইসরেল রাষ্ট্রটির জন্ম হলো ১৯৪৮ সালে তখন একসঙ্গে আরব দেশগুলো আক্রমন চালিয়ে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। 

বর্তমান বিশ্বে ইহুদি সম্প্রদায়ের লোক সংখ্যা দেড় কোটির কিছু বেশী। তা-ও তারা ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন দেশে। যেমন আমেরিকায় আছে প্রায় ৬১ লাখ, ইসরেলে আছে প্রায় ৫২ লাখ, কানাডায় আছে প্রায় ৪ লাখ, বৃটেনে প্রায় ৩ লাখসহ ফ্রান্স, আর্জেন্টিনা, অষ্ট্রেলিয়া, পোল্যাণ্ড, রাশিয়া, সাউথ আফ্রিকা, ইউক্রেন, ওয়েস্টার্ণ ইউরোপ, ইথিওপিয়া প্রভৃতি দেশে।

জনসংখ্যার দিক দিয়ে ঢাকা শহরের কাছাকাছি হলেও বিশ্বে ইহুদি সম্প্রদায় থেকে যুগে যুগে বেরিয়ে এসেছে অসংখ্য প্রতিভাবান ব্যক্তি। প্রধান ধর্মগুলোর পর পৃথিবীতে যে মতবাদটি সবচেয়ে প্রভাব ফেলেছে সেই কমিউনিজমের স্বপ্নদ্রষ্টা কার্ল মার্কস ইহুদি সম্প্রদায় থেকে এসেছেন। বিশ্বের মানুষকে মুগ্ধ করে রাখা যাদু শিল্পি হুডিনি ও বর্তমানে ডেভিড কপারফিল্ড এসেছেন একই কমিউনিটি থেকে। আর আছে, মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড। লেখকদের মধ্যে আর্থার মিলার, ফ্রানজ কাফকা, জন ষ্টাইনব্যাক যেমন এসেছেন তেমনি এসেছেন সাইন্স ফিকশান জগতের সবচেয়ে আলোচিত লেখক আইজাক আসিমভ। মিউজিকে ইহুদি মেনুহিনের অসাধারণ ভায়োলিনের পাশাপাশি রিঙ্গো ষ্টার, মার্ক নাফলারের মতো বাদক যেমন এসেছেন তেমনি বব ডিলান, বব মার্লির মতো গায়কও এসেছেন। 

মাত্র কয়েকজনের নাম দেওয়া হলো। এ-ধরণের নাম অসংখ্য আছে। 

ইহুদি কমিউনিটির সদস্যদের হাতে মেডিসিন, ফিজিক্স, কেমিষ্ট্রি, ইকোনোমিক্স, লিটারেচার ও পিচ বিভাগে এখন পর্যন্ত ১৭৫টিরও বেশী নোবেল পুরষ্কার এসেছে। এ থেকে তাদের মেধার বিস্তার সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া সম্ভব। 


ইসরেলের প্রয়োজনে এসব বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, মিডিয়া মুঘল, রাজনীতিবিদ সবাই মিলিতভাবে তাদের স্বপ্নভূমিকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন। তারা যে যেই মতেরই হোক না কেন, এ-বিষয়ে তাদের কোন মতভেদ থাকে না। ফলে হাজার অপরাধ করার পরও ইসরেলকে স্পর্শ করা যায় না। শুধু আবেগ বা অভিশাপ দিয়ে ইসরেলকে দমন করা সম্ভব নয়। কেননা এর ভূমিটুকু আছে মিডল ইস্টে কিন্তু এর নিয়ন্ত্রকরা আছেন বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। 

http://www.somewhereinblog.net/blog/ashrafmahmud/29267006

No comments:

Post a Comment